মোদী, ভারত, এবং বর্তমান সভ্যতা-সংকট

ফেসবুকে আমার ছেলেবেলার এবং আজীবনের বন্ধুদের অন্যতম স্যমন্তকের একটি মোদী-বিচার লেখা পড়ে মনে হল যে আমার হয়তো উচিত নিজের বক্তব্যটা পেশ করা, যদিও আমি অন্য লোকের উঠোনে গিয়ে নিজের মন্তব্য জাহির করাটা একেবারেই পছন্দ করিনা।

কিন্তু বিষয়টা আমার কাছে খুবই সাম্প্রতিক ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাতে আমার বক্তব্য রাখতে এবং অন্যের ঘাড়ে চেপে না চেঁচানোর সিদ্ধান্ত থেকে না সরতে গিয়ে, একটা ব্লগ লিখে ফেললুম বাংলাতে – ঔ উভয় সংকটের মুশকিল আসানের সন্ধানে।

স্যমন্তকের ফেসবুক পাতার শিরোনাম চিত্র

স্যমন্তক,

আমি সাধারণতঃ অন্য লোকের উঠোনে উচ্চারিত নিজস্ব বক্তব্যের ওপর খবরদারী করতে বা সমালেচনা করতে আসিনা। তবে এইবার তোর উক্তিটা চোখের সামনে এল এবং বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ মনে হল বলে ভাবলাম Facebook’এ আমার ব্যবহারে একটা ব্যতিক্রম হয়তো আনতে পারি এবং মনে করছি তুই অখুশি হবিনা। তাত্পর্যপূর্ণ বিষয়ে মতানৈক্য থাকতেই পারে, যদি তা সসম্ভ্রমে পেশ করা যায়।

স্যমন্তককে আমি আনন্দ পাঠশালা থেকে চিনি এবং একই ক্লাসে একই বছর ইস্কুল পাশ করেছি।

নরেন্দ্র মোদি আগামী নির্বাচন জিতবে কি জিতবে না জানি না – সন্দেহ করি জিতবে, কিন্তু জেতার অন্যতম মূল কারণ নিজগুনের চেয়ে বেশি হবে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পের অভাব।

মোদীর লোকপ্রীয়তার অন্যতম কারণ ছিল ভারতবাসীদের অনেকেরই ইংরেজদের দাক্ষিণ্যে পাওয়া ভণ্ড-ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মুসলমান-পোষণ ও হিন্দু-বিভাগ নীতির ধারাবাহিক সম্প্রসারণের ওপর অরূচি। তাই, দেশের একটি বৃহত গোষ্ঠীর অনেকদিনের জমানো ক্ষোভকে স্বীকৃতি দিয়ে ভাজপা দল ক্ষমতায় এসেছিল। ছোটবেলায় বিজ্ঞান পাঠে শিখেছিলাম – প্রকৃতি শূন্য সহ্য করেনা, তাই শূন্যস্থানকে ভর্তি করে দেয় পূর্ণতা রক্ষা করতে। জনতার বৃহদাংশ হিন্দুদের বঞ্চিত থাকার অনুভূতিটা একরকম রাজনৈতিক শূন্যতা – যা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পুরণ করার সময় এসেছিল এবং ভাজপা তা বুঝতে পারে এবং তাকে ভর করে এক রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করে, যার আধুনিক ফল হল নরেন্দ্র মোদীর কত লোকেদের উত্থান। তবে ক্ষমতায় আসা, আর ক্ষমতায় টিকে থাকা – দুটো দুরকম সমস্যা – এবং সমাধানও সবসময় একই পরিকল্পনা থেকে আসে না।

স্যমন্তক বলেছে ছোটখাটো ছাপোষাদের ঘুষ ও চুরিচামারির রাস্তা বন্ধ হয়েছে। আগের মনমোহন সরকারও একটু একটু করে সেই রাস্তা বন্ধ করার পথে নেমেছিল – মোদী সরকার সেই রাস্তাকে আরও প্রশস্ত করেছে। এক ঝলকে দেখলে তাতে লোকেদের খুশি হবারই কথা, এবং মোদী সরকার তাকে সবার দৃষ্টিগোচরও করেছে নানা প্রকার ঢাক পিটিয়ে। আরও নানা যায়গায় সরকার দেশকে স্বাবলম্বী করার নামে নানা রকম উদ্যোগও নিয়েছে – মানছি।

কিন্তু, দূর থেকে নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে মনে হয় যে – ছোটখাটো লোকেদের চুরি চামারি, দুর্নীতি এবং আমলাতন্ত্র থামিয়ে মোদী সরকার বৃহত কর্পোরেশন এবং ধনকুবেরদের রাষ্ট্র লুঠ করার পথ খুলে দিয়েছে এবং রাষ্ট্রকে দেশী বিদেশী অতিধনী গোষ্ঠীশাসনের অধীনে আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। চুরি এখনও হচ্ছে এবং মনে হয় আগের চেয়ে আরও ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে সেই দূরাচার – এবং তাতে লাভবান হবে মিচকে চোরেরা বা সাধারণ প্রজারা নয়, অন্য এক শ্রেনীর অতিক্ষমতাশীল প্রভুদের দল, যাদের পকেটে সব রাজনীতিবিদরা থাকে এবং মনে হচ্ছে মোদীর জন্যেও এক বিশেষ পকেট তৈরি ছিল শুরু থেকেই।

নানা দেশী এবং আন্তর্জাতিক কারণে ভারতীয় এবং পৃথিবীর জনগন আজ এক নজিরহীন মহাসংকটের সামনে দাঁড়িয়ে – সব দেশের সব রাজণৈতিক দলই এই মানবতালুণ্ঠনে অংশীদার ও ঠিকাদার  মনে হয় – তফাতটা খালি কে কিরকম লিপস্টিক লাগাচ্ছে এবং কিরকম পাউডার মাখছে গালে – ততটুকুই।

আমার নিজস্ব মতে দোষটা জনতার। রাজা হল জনতার প্রতিফলন। জনতা যদি দূরদৃষ্টিহীন, স্বার্থপর, কাপুরুষ বা মেরুদণ্ডহীন, ভীরু হয়, তবে তাদের প্রাপ্য মুখোশপরা সরকারই তারা পাবে।

এতে সবচেয়ে শিক্ষণীয় পাঠ হল – স্বাধীনতা, ন্যায় ও সুবিচার আকাশ থেকে পড়ে না – তাকে অর্জন করতে হয় – তার জন্য মাথার ঘাম ফেলতে হয়, এমনকি রক্তও দিতে হয়।

দুঃখের বিষয় – সুভাসবাবুও জনরক্তস্বল্পতায় কাবু হলেন এবং রবীন্দ্রনাথের বর্ণিত হালের কাছের মাঝি  ঔ ভীরু জনতার অবহেলায় আজ সুদূরে বিলীন।

বেশি বলে ফেলেছি মনে করলে নিজগুনে মাফ করে দিস বাবুয়া।

সবাই ভাল থাকবেন।